গাজায় তীব্র খাবার সামগ্রী সংকট: মুসলিম বিশ্বের জন্য লজ্জাজনক | Voice of Ashfaque


ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় আজ মানবিক বিপর্যয়ের এক ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠেছে। প্রতিদিন সেখানে হাজারো শিশু, নারী ও বৃদ্ধ মানুষ একমুঠো খাবারের জন্য কাতর প্রার্থনা করছে। ইসরায়েলি অবরোধ, বিমান হামলা ও স্থল আগ্রাসনে গাজা আজ কার্যত ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। তবুও প্রাণপণ টিকে থাকার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এই অসহায় জনগণ। অথচ, মুসলিম বিশ্বের নিরবতা ও নিষ্ক্রিয়তা গোটা মানবতার সামনে একটি লজ্জাজনক বাস্তবতা উন্মোচিত করছে।

বর্তমানে গাজার বেশিরভাগ এলাকায় খাদ্য সরবরাহ সম্পূর্ণরূপে বন্ধপ্রায়। বাজারে খাবার নেই, কৃষিকাজ ধ্বংসপ্রাপ্ত, বাইরের জগৎ থেকে কোনো সহায়তা প্রবেশ করতে পারছে না। ইসরায়েলের কঠোর অবরোধের কারণে জীবনযাপনের মৌলিক উপকরণগুলোও গাজাবাসীর নাগালের বাইরে চলে গেছে। বোমাবর্ষণের পাশাপাশি এই খাদ্য অবরোধ যেন ধীরে ধীরে গাজাবাসীকে নিঃশেষ করে দেওয়ার এক নির্মম প্রক্রিয়া হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে শিশুরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। অপুষ্টি, পানির অভাব এবং ওষুধের সংকটে তাদের মৃত্যু প্রতিদিনই বাড়ছে। মা যখন নিজের বুকের দুধ শুকিয়ে যাওয়া দেখে, তখন তার চোখের পানি আর আকুতি এই দুনিয়ার বিবেকবান মানুষদের কাছে করুণ এক প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়—কোথায় তোমাদের মানবতা?

এত বড় বিপর্যয়ের মধ্যেও বিশ্বের ৫০টিরও বেশি মুসলিম রাষ্ট্র যেন আজ নিশ্চুপ। কোটি কোটি মুসলমান বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বসবাস করলেও গাজার জন্য সম্মিলিত কোনো প্রয়াস দৃশ্যমান নয়। নামাজে দোয়া, মিম-শেয়ার কিংবা প্রতিবাদ পোস্ট যথেষ্ট নয়। দরকার ছিল রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপ, কূটনৈতিক চাপে ইসরায়েলের অবরোধ তুলে নেওয়ার দাবি, খাদ্য ও চিকিৎসাসামগ্রী পৌঁছানোর ব্যবস্থাপনা। মুসলিম বিশ্বের এই নিরবতা শুধু হতাশাজনক নয়, এটি একপ্রকার অপরাধও বটে।

আমরা প্রতিনিয়ত ইসলামী ভ্রাতৃত্ব, উম্মাহ, সহমর্মিতা—এসব শব্দ উচ্চারণ করি। কিন্তু এই কঠিন বাস্তবতায় আমাদের সেই কথাগুলো কতটা আন্তরিক, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। শত শত কোটি ডলারের অর্থনীতি, বিশাল সামরিক শক্তি ও ভৌগলিক প্রভাব থাকা সত্ত্বেও আমরা গাজার জন্য একটি কার্যকর খাদ্যবাহী জাহাজ পাঠাতে পারিনি। আজ যদি পৃথিবীর অন্য কোনো অঞ্চলে এমন সংকট হতো, পশ্চিমা বিশ্ব হয়তো তড়িঘড়ি করে সাহায্য পাঠাতো। অথচ আমরা নিজেদের ভাইদের জন্য ন্যূনতম মানবিক সহায়তাও নিশ্চিত করতে পারিনি।

এখানে প্রশ্ন আসে—আমরা কি শুধু দোয়া করে দায়িত্ব শেষ করে ফেলবো? আমরা কি ভাবি না, এই শিশুগুলোর মুখে খাবার তুলে দেওয়াও আমাদের দায়িত্ব? যে জাতি তার দুর্দশাগ্রস্ত ভাইয়ের পাশে দাঁড়ায় না, সে জাতির ওপর আল্লাহর রহমত আসে না—এ কথা আমরা মুখে বললেও কাজে তার প্রতিফলন দেখি না। আমাদের মসজিদে কোটি কোটি টাকা ব্যয় হয়, কিন্তু গাজার একটি শিশু না খেয়ে মারা গেলে আমরা মাথা ঘামাই না। আমাদের হজ কাফেলার সংখ্যা বাড়ে, কিন্তু গাজায় একটি অ্যাম্বুলেন্স পাঠানোর উদ্যোগ নেই। এই বৈপরীত্যই আমাদের অন্তরের কঠোরতার প্রতীক।

আমাদের উচিত, এই সংকটকে শুধুই একটি মানবিক ঘটনা হিসেবে না দেখে, নিজের আত্মসমালোচনার উপলক্ষ হিসেবে গ্রহণ করা। গাজার ক্ষুধার্ত মানুষগুলো যেন আমাদের ঈমানের আয়না হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা যদি সত্যিই নিজেদের মুসলিম ভাবি, তবে এখনই আমাদের জাগতে হবে। সচেতন হতে হবে, আশেপাশের মানুষদের গাজার বাস্তবতা জানাতে হবে, বিশ্বজনমত গড়ে তুলতে হবে এবং বিশ্বাসযোগ্য সংস্থার মাধ্যমে সাহায্য পাঠাতে হবে।

গাজায় একজন শিশুর কান্না, একজন বৃদ্ধার প্রার্থনা, একজন মায়ের আর্তনাদ—এই সবকিছুই আল্লাহর কাছে সাক্ষী হয়ে থাকবে। ইতিহাস মনে রাখবে কারা গাজার জন্য কিছু করেছিল, আর কারা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। আজকের নিরবতা কালকের লজ্জা হবে। এখনই সময়—এক হবার, দাঁড়ানোর, গাজার পাশে দৃঢ়ভাবে দাঁড়ানোর।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ