সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সরকারকে যে বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করতে হবে

বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা এখন ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। প্রতিদিন পত্রিকার পাতায় বা টেলিভিশনের খবরের শিরোনামে সড়ক দুর্ঘটনার নির্মম চিত্র উঠে আসে। প্রাণ হারাচ্ছেন বহু মানুষ, পঙ্গুত্ব বরণ করছেন অসংখ্য পথচারী। এই দুর্ঘটনাগুলো শুধু ব্যক্তি বা পরিবারের ক্ষতি নয়, বরং পুরো জাতির জন্য ভয়ানক এক সংকট তৈরি করছে। জাতীয় উৎপাদনশীলতা কমছে, অর্থনৈতিক ক্ষতির পাশাপাশি সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থাও বিঘ্নিত হচ্ছে। তাই সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সরকারের দায়িত্ব এখন শুধু নৈতিকতার জায়গা থেকেই নয়, বরং একটি রাষ্ট্রীয় জরুরি কর্তব্যে পরিণত হয়েছে।

প্রথমত, দেশে ট্রাফিক আইন থাকলেও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এখনও বড় ধরনের শৈথিল্য রয়েছে। বেশিরভাগ চালকই নিয়ম মানতে অভ্যস্ত নন। অনেক সময় দেখা যায়, ফিটনেস সনদহীন কিংবা লাইসেন্সবিহীন যানবাহন সড়কে চলছে অনায়াসে। আবার কিছু চালকের বয়স ও অভিজ্ঞতার যথাযথ প্রমাণ না থাকা সত্ত্বেও তারা বড় বড় যানবাহন চালিয়ে থাকে, যা বিপজ্জনক। সরকারের উচিত সড়কে নিয়মশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে কঠোর আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা। নিয়মিত মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে অপরাধীদের বিরুদ্ধে দ্রুত ও দৃশ্যমান শাস্তি নিশ্চিত করা গেলে মানুষ সচেতন হবে।

এছাড়া, চালকদের প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করা সময়ের দাবি। আমাদের দেশে এখনো অনেক চালক প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ ছাড়াই ড্রাইভিং লাইসেন্স সংগ্রহ করে থাকে। এটা বন্ধ করতে হবে। যারা নতুন লাইসেন্স নিতে আসবে, তাদের অবশ্যই নির্ধারিত প্রশিক্ষণ কোর্স শেষ করে তবেই পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ দিতে হবে। একই সঙ্গে পুরনো চালকদেরও প্রতি পাঁচ বছরে একবার প্রশিক্ষণ গ্রহণ ও মানসিক স্বাস্থ্য পরীক্ষার আওতায় আনা যেতে পারে। কারণ, একজন মানসিকভাবে অসুস্থ বা অতিরিক্ত ক্লান্ত চালক যে কোনো সময় ভয়াবহ দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে।

সড়কের মানোন্নয়ন ও সংস্কারের বিষয়েও সরকারকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। দেশের অনেক সড়কই সংকীর্ণ, খানাখন্দে ভরা কিংবা সঠিকভাবে সংস্কার করা হয় না। এসব সড়কে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বেড়ে যায় বহুগুণ। বিশেষ করে মহাসড়কগুলোতে আলাদা লেন ব্যবস্থা, ওভারপাস, আন্ডারপাস এবং ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণের উদ্যোগ দ্রুত গ্রহণ করা প্রয়োজন। শহরের ভেতরে ফুটপাত দখলমুক্ত রাখতে হবে, যেন পথচারীরা নিরাপদে হাঁটতে পারে।

গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরানোও জরুরি। বিশেষ করে বাস চালকদের বেপরোয়া প্রতিযোগিতা, স্টপেজ ছাড়া যাত্রী ওঠা-নামা ও নির্দিষ্ট সময়সীমায় বেশি ট্রিপ দেওয়ার প্রবণতা দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। এজন্য মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলোকে এককাঠিন্যের মধ্যে আনতে হবে, এবং পরিবহন মালিকদেরও জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিরাপদ সড়ক নিয়ে আলাদা ক্লাস চালু করা যেতে পারে, যাতে ছোটবেলা থেকেই শিশু-কিশোরদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি হয়। পাশাপাশি গণমাধ্যমে সচেতনতামূলক প্রচারণা চালিয়ে সাধারণ মানুষকে ট্রাফিক আইন মেনে চলতে উদ্বুদ্ধ করা দরকার।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো—দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসনিক ব্যবস্থা। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, ট্রাফিক আইন বাস্তবায়নে দুর্নীতি বাধা হয়ে দাঁড়ায়। ঘুষ দিয়ে ফিটনেসবিহীন গাড়ি সড়কে চলে, লাইসেন্স পায় অযোগ্য চালকরা। এসব দুর্নীতি বন্ধ করতে পারলে সড়ক দুর্ঘটনা অনেকটাই কমে আসবে।

সবশেষে বলা যায়, সড়ক দুর্ঘটনা বন্ধ করা একদিনের কাজ নয়। এটি একটি ধারাবাহিক ও সমন্বিত উদ্যোগের ফল হতে পারে। সরকারের সদিচ্ছা, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার আন্তরিকতা, চালক ও পথচারীদের সচেতনতা—সব মিলিয়েই নিরাপদ সড়কের স্বপ্ন বাস্তবায়ন সম্ভব। নিরাপদ সড়ক শুধু একটি দাবি নয়, বরং এটি মানুষের জীবন বাঁচানোর লড়াই। সরকারকে অবশ্যই এখনই এই বিষয়ে শক্তিশালী ও দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে হবে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ