অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কিভাবে দুর্নীতি দমন করতে পারে? বাস্তবভিত্তিক রোডম্যাপ

বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব হয় একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন করা। কিন্তু শুধু নির্বাচনের ব্যবস্থাপনা নয়, এই সময়টিই হতে পারে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেওয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ। যদি আন্তরিকতা ও স্বচ্ছতা নিয়ে পদক্ষেপ নেওয়া হয়, তাহলে অন্তর্বর্তী সরকার দুর্নীতি দমনের একটি কার্যকর ভিত্তি তৈরি করতে পারে।

প্রথমেই যে কাজটি জরুরি, তা হলো যেসব দুর্নীতির তথ্য ইতোমধ্যে বিভিন্ন সংস্থার কাছে রয়েছে, সেগুলোর বিচার প্রক্রিয়া দ্রুত শুরু করা। এ জন্য বিশেষ দুর্নীতি দমন ট্রাইব্যুনাল গঠন করা যেতে পারে। এর মাধ্যমে সমাজে একটি বার্তা যাবে যে, কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়।

প্রশাসনের মধ্যে যেসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে বা যাদের দলীয় স্বার্থে বসানো হয়েছে, তাদের বদলি বা অপসারণ করে নিরপেক্ষ ও দক্ষ প্রশাসক দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে হবে। এতে আমলাতান্ত্রিক পক্ষপাত হ্রাস পাবে এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিত হবে।

জনগণকে দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে সম্পৃক্ত করতে একটি হটলাইন চালু করা যেতে পারে, যেখানে কেউ নাম প্রকাশ না করেই দুর্নীতির তথ্য দিতে পারবে। তথ্যদাতাদের সুরক্ষা ও উৎসাহ প্রদান করলে জনগণের আস্থা ফিরে আসবে।

সরকারি কেনাকাটা ও টেন্ডার ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা আনাও খুব জরুরি। সব টেন্ডার ও প্রকল্প যেন অনলাইনে প্রকাশ্য থাকে, তা নিশ্চিত করতে হবে। এতে সিন্ডিকেট ও ঘুষ-কমিশনের সুযোগ কমে আসবে।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার চাইলে অর্থপাচারকারীদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে পারে। যেসব ব্যক্তি বা গোষ্ঠী দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার করেছে, তাদের তালিকা করে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে সম্পদ ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। একইসাথে দুর্নীতিতে জর্জরিত কিছু প্রতিষ্ঠান যেমন ভূমি অফিস, বিআরটিএ বা রাজস্ব বিভাগ— এসব জায়গায় প্রশাসনিক সংস্কার ও কঠোর নজরদারি চালানো দরকার।

গণমাধ্যম ও সিভিল সোসাইটিকে দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে সম্পৃক্ত করা যেতে পারে। তাদের স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিলে দুর্নীতির বহু তথ্যই জনসম্মুখে আসবে। ডিজিটালাইজেশন ও ই-গভর্ন্যান্স চালুর মাধ্যমে সাধারণ মানুষের সরকারি সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বাড়ানো সম্ভব। ঘুষ ছাড়া সেবা পাওয়ার পরিবেশ তৈরি হলে জনগণের আস্থা বাড়বে।

প্রতিটি সরকারি দপ্তরের আয়-ব্যয় ও কার্যক্রম নিয়মিত অডিট ও যাচাই করে প্রকাশ্যে আনতে হবে। এতে অর্থ অপচয় ও লোপাট কমে আসবে। পাশাপাশি জনসচেতনতা বাড়ানোও গুরুত্বপূর্ণ। দুর্নীতির ভয়াবহতা ও পরিণতি নিয়ে স্কুল-কলেজে, মসজিদ-মন্দিরে ও গণমাধ্যমে সচেতনতামূলক প্রচার চালানো যেতে পারে।

সবচেয়ে বড় কথা, একটি আন্তরিক ইচ্ছা থাকলে অল্প সময়ের মধ্যেও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দুর্নীতি দমনের পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি গড়ে তুলতে পারে। এটি শুধু পরবর্তী নির্বাচনের জন্য নয়, বরং দেশের ভবিষ্যৎ শাসনব্যবস্থার জন্য একটি ইতিবাচক দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ