বাংলাদেশের সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ: নতুন প্রজন্মের ভাবনা

Bangladesh flag
বাংলাদেশ—দক্ষিণ এশিয়ার একটি ছোট্ট ভূখণ্ড হলেও এর গৌরবগাথা বিশাল। এক সময় পৃথিবীর দরিদ্রতম দেশগুলোর একটি ছিল বাংলাদেশ। স্বাধীনতা অর্জনের পর পরই যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশকে নতুন করে গড়ে তোলার দায়িত্ব এসে পড়ে মানুষের কাঁধে। সেখান থেকেই আজকের বাংলাদেশের গল্প শুরু। নানা প্রতিকূলতার মাঝেও বাংলাদেশ এখন বিশ্বের অন্যতম সম্ভাবনাময় দেশ হিসেবে নিজেদের জায়গা করে নিয়েছে।

বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শক্তি হচ্ছে এখানকার জনগণ, বিশেষ করে তরুণ সমাজ। জনসংখ্যার একটি বিশাল অংশ তরুণ, যাদের মধ্যে রয়েছে অসীম সম্ভাবনা, শক্তি আর উদ্যম। আজ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, সামাজিক উন্নয়ন ও প্রযুক্তিতে অগ্রগতির পেছনে মূল ভূমিকা রাখছে এই নতুন প্রজন্ম।

কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি থেকে বাংলাদেশ এখন শিল্পভিত্তিক অর্থনীতির দিকে অগ্রসর হচ্ছে। তৈরি পোশাক শিল্প, রেমিটেন্স, তথ্যপ্রযুক্তি খাত বাংলাদেশের অর্থনীতিকে শক্ত ভিত্তি দিয়েছে। পাশাপাশি কৃষি খাতও আধুনিকায়নের ফলে উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের কৃষকরাও এখন মোবাইল ফোনে বাজারদর জানতে পারে, ডিজিটাল ব্যাংকিং সেবা নিতে পারে।

তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বাংলাদেশের উন্নয়ন সত্যিই প্রশংসনীয়। বর্তমানে বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ফ্রিল্যান্সিং দেশ হিসেবে পরিচিত। হাজার হাজার তরুণ-তরুণী অনলাইন প্ল্যাটফর্মে কাজ করে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করছে। এছাড়া দেশে ই-কমার্স ও স্টার্টআপ সংস্কৃতি দিন দিন বিকশিত হচ্ছে। তরুণ উদ্যোক্তারা নতুন নতুন ধারণা নিয়ে এগিয়ে আসছে, তৈরি করছে কর্মসংস্থান, দেশের অর্থনীতিতে যোগ করছে নতুন মাত্রা।

বাংলাদেশের নারীরাও এখন পিছিয়ে নেই। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চাকরি, ব্যবসা, এমনকি প্রযুক্তি খাতেও নারীদের অংশগ্রহণ চোখে পড়ার মতো। নারী উদ্যোক্তা তৈরিতে সরকারের বিভিন্ন প্রকল্প, বেসরকারি উদ্যোগ এবং সামাজিক সচেতনতা বাংলাদেশের পরিবর্তনের অন্যতম নিয়ামক শক্তি হিসেবে কাজ করছে।

তবে এসব আশাব্যঞ্জক উন্নয়নের মধ্যেও সামনে রয়েছে বড় কিছু চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশের অন্যতম বড় সমস্যা হলো বেকারত্ব। প্রতিবছর হাজার হাজার শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা শেষ করেও চাকরির জন্য হাহাকার করে। শিক্ষার মানের ঘাটতি এবং বাস্তবমুখী দক্ষতার অভাব অনেককেই কর্মসংস্থানের বাইরে রাখছে।

শুধু তাই নয়, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও দুর্নীতি দেশের উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করছে। প্রশাসনিক দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, দলীয় স্বার্থপরতা মানুষের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে। নতুন প্রজন্মের মধ্যে এক ধরনের হতাশা তৈরি হচ্ছে, বিশেষ করে যখন যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও তারা দেখতে পায়—দুর্নীতিগ্রস্তরা বেশি সুযোগ পাচ্ছে।

জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকিগুলোর একটি। বিশেষ করে উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষগুলো বছরের পর বছর বন্যা, ঘূর্ণিঝড় ও নদীভাঙনের শিকার হচ্ছে। জলবায়ু উদ্বাস্তুদের সংখ্যা বাড়ছে, যা দেশের সামাজিক ভারসাম্যেও প্রভাব ফেলতে পারে।

আরেকটি বড় সমস্যা হলো গ্রাম-শহরের বৈষম্য। রাজধানীসহ বড় শহরগুলোতে সুযোগ-সুবিধা থাকলেও গ্রামের মানুষ এখনও পিছিয়ে রয়েছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন প্রয়োজন গ্রামগুলোতে। দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য এই বৈষম্য দূর করা জরুরি।

সবচেয়ে আশার কথা হলো—এই নতুন প্রজন্ম হার মানতে চায় না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে তারা নিজেদের মত প্রকাশ করছে, অন্যায়ের প্রতিবাদ করছে, উদ্ভাবনী কাজের সাথে যুক্ত হচ্ছে। ফ্রিল্যান্সিং, অ্যাপ ডেভেলপমেন্ট, ডিজিটাল মার্কেটিং, ইউটিউব, কনটেন্ট ক্রিয়েশন—এতসব প্ল্যাটফর্ম এখন তরুণদের হাতের মুঠোয়।

তরুণদের এই শক্তিকে কাজে লাগাতে হলে চাই সঠিক দিকনির্দেশনা। শিক্ষাব্যবস্থায় প্রয়োজন ব্যাপক সংস্কার, চাকরির বাজারে দরকার দক্ষতার সাথে মিল রেখে নতুন নতুন খাতের উন্নয়ন। তথ্যপ্রযুক্তিকে আরও সহজলভ্য করে দিতে হবে গ্রামগঞ্জেও। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাতেরও এগিয়ে আসা প্রয়োজন।

সবশেষে বলা যায়—বাংলাদেশ এখন আর সম্ভাবনার দেশ নয়, বাস্তবে রূপান্তরের পথে। নতুন প্রজন্ম যদি ঐক্যবদ্ধ হয়, দূর করে হতাশা আর নেতিবাচকতা, তাহলে এই দেশ একদিন সত্যিকার অর্থেই একটি উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হবে। শুধু প্রয়োজন ইতিবাচক মানসিকতা, দেশপ্রেম, আর মেধার সঠিক ব্যবহারের।

বাংলাদেশের গল্প এখানেই শেষ নয়—এটাই কেবল শুরু। এই শুরুটা নতুন প্রজন্মের হাত ধরে এগিয়ে যাবে আরও অনেক দূর, অনেক উঁচুতে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ